Header Ads Widget

Responsive Advertisement

#তিন_গোয়েন্দা সিরিজ থেকে আলাস্কা_অভিযান - রাকিব হাসান

 প্রথম পর্ব 


#তিন_গোয়েন্দা সিরিজ থেকে


#আলাস্কা_অভিযান - রাকিব হাসান


বাঁয়ে তীক্ষ্ণ মোড় নিল বুশ প্লেন। ফায়ারওয়ালে বুট চেপে ধরে নিজেকে সামলাল পাইলটের পাশের সিটে বসা মুসা। থাবা দিয়ে ধরে ফেলল মাথার ওপরের হাতলটা। জানালা দিয়ে তাকাল হাজার ফুট নীচে।

পাইলট ডিউক আইকহ্যাম বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই, যে গ্লিটার টাউন।

শহরটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মুসা। যেদিকেই তাকায়, শুধু গাছ আর গাছ। সাদা রঙের চওড়া একটা কাস্তে চলে গেছে যেন গাছের জঙ্গলকে ভেদ করে। ওপর থেকে মহাসড়কের মত লাগছে কাস্তেটাকে। কিন্তু মুসা জানে, ওটা রাস্তা নয়, নদী। ইউকন রিভার। বছরের এ সময়টায় নদীর পানি জমাট বরফ। দশ ফুট পুরু হয়ে বরফের স্তর পড়েছে। শহরটা চোখে পড়ল হঠাৎ। নদীর দিকে মুখ করা। দূর থেকে বাড়ি-ঘরগুলোকে খেলনার মত লাগছে। ওখানেই চলেছে কিশোর ও মুসা।

দারুণ! চিৎকার করে বলল মুসা। সাংঘাতিক!

হাসল ডিউক। এটা সত্যিকারের বুশ কান্ট্রি। নির্জন। বিশাল এলাকা জুড়ে কোন মানুষের দেখা পাবে না।

বিগ কান্ট্রি আলাস্কা! বিড়বিড় করে বলল পিছনের সিটে বসা কিশোর। এয়ারস্ট্রিপটা কই, ডিউক? শুরুতে মিস্টার ডিউক বলেছিল, কিন্তু ডিউক জোরে হাত নেড়ে বাতাসে থাবা মেরে জানিয়ে দিয়েছে, শুধু ডিউক। মিস্টার-ফিস্টার ভাল্লাগে না আমার।

ডিউকের হাসিটা চওড়া হলো। আছে তো। ওই যে


নীচেই। এক মাইল চওড়া, দুই হাজার মাইল লম্বা।

তারমানে নীচের ওই বরফে ল্যাণ্ড করবেন? অবাক হলো মুসা।

এত অসমান…

আগে আরও খারাপ ছিল, ডিউক জানাল। গেল শীতে এখানকার লোকে সমান করে দিয়েছে। আমার নামার সুবিধের জন্য। আচমকা সামনের দিকে নিচু হয়ে গেল প্লেনের নাক। গাছের ওই সারি দুটো দেখছ? ওগুলোই রানওয়ের নিশানা। দুটোর ঠিক মাঝখানে নামালে আর কোন ভয় নেই।

থ্রটল অ্যাডজাস্ট করল ডিউক। ফ্ল্যাপ নামিয়ে, গতি কমিয়ে নামার জন্য তৈরি হচ্ছে।

শূন্য থেকে পাথর পড়ার মত ঝপ করে অনেকখানি নীচে নেমে এল প্লেন। এয়ার পকেটে পড়েছে। পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠল মুসার। ডিউকের সঙ্গে কথা বলাটা এখন নিরাপদ নয়। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল কিশোরের দিকে। দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে, কী বলো? জোসিও আমাদের দেখলে খুশি হবে। বিশ্বাসই করতে পারবে না, ওর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে সত্যি সত্যি চলে আসব আমরা।

তা ঠিক, মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

জোসি মানে জোসেফ টিনুক। ওদের বন্ধু। অ্যাথাবাস্কান। গ্লিটারের স্থানীয় অধিবাসী। জন্মের পর থেকেই নীচের ওই খুদে শহরটায় বাস করছে। ব্যুরো অভ ইণ্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্সের স্পন্সর করা খেলাধূলার প্রোগ্রামে ফুটবল খেলতে কিছু দিনের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। কয়েক হপ্তা কাটিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে, রকি বিচে। ফিরে আসার সময় গ্লিটার টাউনে ওদেরকে দাওয়াত করেছিল জোসি। বসন্তের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হতেই তাই বেরিয়ে পড়েছে কিশোর ও মুসা। আলাস্কাও দেখা হবে, ভগ জে রেসে বন্ধুকে সাহায্যও করতে পারবে। অ্যাঙ্কারেজ থেকে শুরু হয় ইডিটাররাডের বিখ্যাত এই কুকুর-দৌড়।

বাবা-মার সঙ্গে নিউ ইয়র্কে যেতে হয়েছে রবিনকে, তাই আসতে পারেনি। ওর বাবা মিস্টার মিলফোর্ড ওখানকার একটা বড় পত্রিকায় কাজ নিয়েছেন। যদি ভাল লাগে, ওখানেই থেকে যাবেন, রকি বিচে আর ফিরবেন না। আপাতত ওখানকার কোনও একটা স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হবে রবিনকে। বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল রবিন। মুসা তো কেঁদেই ফেলেছিল। মন খারাপ হয়ে। গিয়েছিল কিশোরেরও।

শক্ত হয়ে বসো, ডিউকের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল কিশোর।

প্লেনের নাক আরও নামিয়ে দিল ডিউক।

মাথার ওপরের হ্যাণ্ডেলটায় মুসার আঙুলের চাপ আরও শক্ত হলো। ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে ওর মনে হচ্ছে, প্লেনটা নামছে না, বরং বিশাল ধরণীই দ্রুতবেগে উঠে আসছে ওদের দিকে।

আরও গতি কমাল ডিউক। জয় স্টিক টেনে নাক সোজা করল। সামান্য সামনে ঠেলে দিল স্টিকটা। নদীর বরফ স্পর্শ করল প্লেনের স্কি। রিভার্স-এ দিল প্রপেলার। থ্রটল বাড়িয়ে দিল। গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন। থরথর করে কেঁপে উঠল প্লেনের শরীর। আঁকি খেল দুতিনবার। নাচতে নাচতে এগিয়ে গেল কয়েক গজ। তারপর থেমে গেল।

হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে মোটর বন্ধ করে দিল ডিউক। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ করে নীরবতা এসে ধাক্কা মারল যেন কানের পর্দায়। রীতিমত ব্যথা হচ্ছে কানে।

পার্কার জিপার তুলে দাও, বলতে বলতে দরজা খোলার হ্যাণ্ডেলের দিকে হাত বাড়াল ডিউক। এখানকার ঠাণ্ডা কিন্তু ভয়ানক। বাতাস ছাড়াই তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নীচে, আর যখন বাতাস বয়, তখন তো ভয়াবহ অবস্থা।

পার্কার জিপার তুলে দিয়ে প্লেন থেকে নেমে এল কিশোর ও মুসা।

আমরা যে এসেছি শহরবাসী কি জানে? কথা বলার সময় নিজের মুখ থেকে বেরোনো বাতাস মুহূর্তে বরফের কণা হয়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মুসা।

তা তো জানেই, ডিউক বলল। ও, বুঝতে পারনি তা হলে, জানানোর জন্যই তো শহরের ওপর দিয়ে চক্কর দিয়ে এলাম। ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্ট খুলে কিশোর-মুসার ডাফেল ব্যাগগুলো বের করে বরফের ওপর নামিয়ে রাখল ও।

গ্লিটার টাউন, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বিড়বিড় করে নিজেকেই প্রশ্ন করল কিশোর, আজৰ নাম। নেটিভ আমেরিকান

শহরগুলোর সাধারণত এ রকম নাম হয় না।

ফ্রেইট কম্পার্টমেন্ট থেকে নানা রকম বাক্স আর প্যাকেট টেনে নামাতে শুরু করল ডিউক। সেই গোল্ড রাশের যুগে… গোন্ড রাশ বোবো তো?

যে সময়টায় সোনার খোঁজে খেপা হয়ে গিয়েছিল মানুষ, কিশোর জবাব দিল। পাগলের মত সোনা খুঁজে বেড়াত, স্বর্ণসন্ধানের সেই যুগটাকে বলে গোন্ড রাশ। স্বর্ণসন্ধানীদের বলে প্রসপেক্টরস।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল ডিউক। একশো বছর আগে সেই গোন্ড রাশের যুগে হাজার হাজার খনি-শ্রমিক আর প্রসপেক্টরস এসে হানা দিয়েছিল এখানকার পাহাড়-পর্বতগুলোয়। চকচকে সোনা-বোধহয় এই কথাটার ওপর ভিত্তি করেই ওরা শহরটার নাম রেখেছিল গ্লিটার টাউন। ভীষণ পছন্দের জায়গা ছিল এটা ওদের কাছে। কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে। ধীরে ধীরে এখানকার সোনা শেষ হয়ে এল। চলে গেল বাইরে থেকে আসা খনি-শ্রমিকেরা প্রায় সবাই…।

কিশোর! নদীতীরের দিকে আঙুল তুলল মুসা, দেখো, ও জোসি না?

ওর মতই তো লাগছে, কিশোরের কণ্ঠে উত্তেজনা।

প্রায় এক শ গজ দূরে মাঝারি উচ্চতার একটা গাট্টাগোট্টা মূর্তিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখা গেল বরফে ঢাকা নদীতীর ধরে। পার্কার হুড পিছনে নামানো। চওড়া মুখ, উঁচু চিবুক আর কালো চুল দেখে দূর থেকেও বন্ধুকে চিনতে পারল মুসা।

টান দিয়ে যার যার ব্যাগ তুলে নিল কিশোর ও মুসা। প্রায় ছুটতে শুরু করল জোসির দিকে।

কিশোর! মুসা! চিৎকার করতে করতে জোসিও ছুটে এল। কাছে এসে হাত মেলাল। পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

ভাল, জবাব দিল কিশোর।

রবিন আসেনি?

নাহ্, আসতে পারেনি। নিউ ইয়র্কে।

আহহা, তাই। ও এলে খুব ভাল হতো।

তা তো হতোই। কিন্তু কী আর করা।

পথে কোন অসুবিধে হয়নি তো?

হয়েছে কি না টেরই পাইনি, এতই কুঁদ হয়ে ছিলাম। দেখার মত জায়গা।

ডিউকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জোসির পিছু পিছু শহরের দিকে হেঁটে চলল কিশোর-মুসা। গ্লিটারকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেল। দুই সারি পাহাড়ের মাঝখানে উপত্যকায় গড়ে উঠেছে শহরটা। ছড়ানো ছিটানো কাঠের কেবিনগুলো জড়সড় হয়ে আছে তীব্র শীতে। ধাতব স্টোভের পাইপ বেরিয়ে গেছে কেবিনের ছাত ফুড়ে। সেগুলো দিয়ে সাদা ধোয়া উঠে যাচ্ছে সুমেরুর পরিষ্কার নীল আকাশে।

জোসি বলল, তোমাদের কেবিনের স্টোভটা চালু করা দরকার। ঠিক আছে নাকি কে জানে। অনেকদিন চালু করা হয় না। আগে ওটা আমার কেবিন ছিল। আব্বা-আম্মা ফেয়ারব্যাংকসে জুততার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে চলে যাবার পর থেকে বহুদিন ঢুকিও না ওখানে, দেখাও হয় না। এখন ওদের বড় কেবিনটায় আমি থাকি। চাচা-চাচীর ওখানে খাই।

জোসি জানাল, ওর চাচার নাম জেফরি, চাচী এরিনা।

চলতে চলতে শহরের একমাত্র দোতলা বাড়িটার দিকে চোখ পড়ল মুসার। এটাও কাঠের তৈরি। সামনের দিকে কাঠের সাইনবোর্ডের লেখাগুলো জোরে জোরে পড়ল ও, জেনারেল স্টোর, প্রোপ্রাইটরলুক স্টার্লিং। বলল, সিনেমায় দেখা পুরানো ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মত করে লিখেছে।

হাসল জোসি। তা ঠিক। পুরানো আমলে বুনো পশ্চিমের মতই স্টেজকোচ আর ওয়্যাগন ট্রেন আসত এখানেও, এখন আসে ডিউকের এরোপ্লেন। ফেয়ারব্যাংকসে মালের অর্ডার দেয় লুক। ওর দোকানে যদি কিছু না পাও, গ্লিটারের আর কোথাও সেটা পাবে না, ওই জিনিসটা ছাড়াই চালাতে হবে তোমাকে।

নদীর দিক থেকে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকাল তিন কিশোর।

ডিউক চলে যাচ্ছে, জোসি বলল। সপ্তাহে একবার করে মালপত্র আর ডাক নিয়ে আসে ও।

নদীর দুই তীরে প্রুস গাছের সারি। মাঝখানের বরফে ঢাকা নদীর ওপরের অস্থায়ী রানওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করল প্লেনটা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল বিশাল রাজহাঁসের মত। মোড় নিয়ে উড়ে গেল পশ্চিমে।

শহরের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাদা একটা বাড়ি দেখাল জোসি। ছোট ছোট জানালা। অ্যাসেম্বলি রুম। পুরানো আমলে গোল্ড রাশের দিনে ওটাকে ড্যান্স হল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখন শহরের লোকে ওখানে সভাটভা করে।

বাড়িটার প্রবেশ পথের একপাশে বুলেটিন বোর্ড। তাতে বড় বড় দুটো পোস্টার লাগানো। একটা পোস্টার ভাল কাগজে মেশিনে ছাপা। গ্লিটার টাউনের ভবিষ্যৎ উন্নতিতে যারা বিশ্বাসী, তাদেরকে হ্যাঁ ভোট দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। আরেকটা পোস্টার সস্তা কাগজে, হাতে লেখা। যারা লিখেছে তাদের স্লোগান শহর বাঁচাতে চাইলে না ভোট দিন।

কী ব্যাপার? পোস্টার দুটো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, শহরে নির্বাচন নাকি?

নির্বাচন না, জোসি জানাল, থিম পার্ক কর্পোরেশন নামে একটা কোম্পানি গ্লিটারকে টুরিস্ট স্পট বানাতে চায়। এ ব্যাপারে এখানকার জনগণের মতামত যাচাইয়ের জন্য এই ভোটের ব্যবস্থা।

ডিজনি ওয়ার্ল্ডের মত কোন কিছু? জড়সড় হয়ে কুঁকড়ে থাকা কেবিনগুলোর দিকে তাকাল মুসা।

হাসল জোসি। কেন, আইডিয়াটা খারাপ মনে হচ্ছে? এ রকম একটা আদিম জায়গাকে থিম পার্ক বানাবে, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, তাই না?

শহরের লোকের প্রতিক্রিয়া কী? কিশোর জিজ্ঞেস করল। তারা কী বলে?

এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ থিম পার্কের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে।

সামনে মূল রাস্তাকে ক্রস করে গেছে আরেকটা রাস্তা। সেটা ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছে একজন মানুষ। বড় বড় চুল প্রায় জট পাকিয়ে গেছে। গায়ে সবুজ পার্কা। পরনে উলের ঘন বুনটের ভারী প্যান্ট। দোমড়ানো। ময়লা। নিচুস্বরে জোসিকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কে লোকটা?

টেক্স ফেরানি। লোকে ডাকত গোল্ড ফেরানি। ডাকতে ডাকতে এখন গোল্ড হয়ে গেছে ওর ডাকনাম, জোসি বলল। শহরের বাইরে ছোট্ট একটা গোল্ড ক্লেইম আছে ওর। গোল্ড ক্লেইম বোঝো?

মাথা ঝাঁকাল মুসা। সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন জায়গার বৈধ মালিক।

হ্যাঁ। গোল্ড এক বিচিত্র চরিত্র।

সোনা মানে তো বিরাট ব্যাপার, মুসা বলল। কিন্তু এ লোকটাকে দেখে খাবার পায় বলেই মনে হয় না।

আসলেই তা-ই, টাকা নেই ওর। পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছে সোনা খুঁজে খুঁজে। এখনও কিছুই করে উঠতে পারল না বেচারা। তবে আশা ছাড়েনি, সোনা খোজায় ওর বিরাম নেই।

জোসির সঙ্গে শহরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল কিশোর-মুসা। শহরের অন্যপাশে এসে একটা কেবিন দেখিয়ে জোসি বলল, ওইটা আমার চাচার কেবিন।

তোমার চাচার ছেলেমেয়ে নেই? মুসা জানতে চাইল।

আছে। এক মেয়ে। নাম মুনস্টোন। তোমাদের এগিয়ে আনার জন্য আমার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু লাকড়ি কেটে আনাটাও জরুরি। সেজন্য বনে গেছে। অসুবিধে নেই, পরেও দেখা করতে পারবে। আর ওই যে কেবিনটা দেখছ, এটা তোমাদের।

চাচার কেবিন থেকে দশ-বারো গজ দূরে আরেকটা ছোট কেবিনে কিশোরদেরকে নিয়ে এল জোসি। দুটো বাংক। একগাদা কম্বল। এ ছাড়া একটা টেবিল, একটা চেয়ার, আর পেটমোটা এক পুরানো চুলা আছে। মাটিতে বিছানো ভালুকের চামড়ায় তৈরি একটা মাদুর। চুলার পাশে একটা কাঠের খোলা বা লাকড়িতে বোঝাই।

এখানে থাকতে তোমাদের কষ্ট হবে না তো? জোসি জিজ্ঞেস করল। তোমাদের বাড়ির মত আরাম পাবে না আগেই বলে দিচ্ছি।

আমার তো খারাপ লাগছে না, হাতের ব্যাগটা একটা বাংকে নামিয়ে রাখল কিশোর। বরং মনে হচ্ছে আরামেই থাকতে পারব। শোনো, আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বহু খারাপ জায়গায় থেকে অভ্যাস আছে আমাদের।

ঠিক, মুসা বলল। ওসব জায়গার তুলনায় কেবিনটা তো পাঁচতারা হোটেল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জোসি। বন্ধুদের থাকার জায়গা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল ও, বোঝা গেল। জিজ্ঞেস করল, আমার জেটানা কুকুরগুলো দেখবে?

নিশ্চয়ই, জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল না মুসা।

কেবিন থেকে বেরিয়ে শহরের সীমানা ধরে এগিয়ে চলল ওরা। এক জায়গায় কতগুলো কেনল চোখে পড়ল। কুকুরের ঘরগুলোর কাছে প্রায় দুই ডজন কুকুর বাধা। ওদের দেখে জোর গলায় চচামেচি শুরু করল ওগুলো। প্রচুর লাফালাফি আর লেজ নেড়ে স্বাগত জানাল।

সবগুলো তোমার কুকুর? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

হ্যাঁ। এখানে আছে একুশটা। তবে ইডিটারোড রেসে বারোটার বেশি ব্যবহার করব না। হাতে আরও সময় নিয়ে আসা উচিত ছিল তোমাদের। তাহলে রেসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে যেতে পারতে।

থাকতে পারলে খুশিই হতাম, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু কী করব, স্কুল খুলে যাবে।

স্কুল কামাই দিয়ে হলেও থাকতে রাজি আছি আমি, মুসা বলল। রেসের শেষ দেখতে না পারলে মনে খুঁতখুঁতি থেকে যাবে।

নাহ্, রেসের জন্য স্কুল কামাই দেয়া ঠিক হবে না, কিশোর বলল।

বেশির ভাগ দর্শকই রেসের শুরুটা কেবল দেখে, জোসি বলল। অনেক লম্বা পথ। অ্যাঙ্কারেজ থেকে নৌম পর্যন্ত এগারোশো মাইল। এতখানি তো আর সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া সম্ভব না।

হাঁ করে তাকিয়ে রইল মুসা। এগারোশো মাইল!

একটা কুকুরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল জোসি। ওদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে কুকুরটা। ওর নাম ডায়মণ্ডহার্ট।

হীরকহৃদয়, বিড়বিড় করল কিশোর।

কী বললে?

ডায়মণ্ডহার্টের বাংলা করলাম।

আচ্ছা, হাসল জোসি। বাংলা নামটাও শুনতে ভাল লাগছে। সুন্দর একটা ছন্দ আছে। কিন্তু এখন আর বাংলা নামে ডাকলে সাড়া দেবে না ওটা, নইলে রেখেই দিতাম।

বড় একটা হাস্কি কুকুরের পাশে বসে ওটার গলা জড়িয়ে ধরল জোসি। কুকুরটার গায়ের রঙ সাদা আর ধূসরে মিশানো। চোখ টলটলে নীল। আদর পেয়ে জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। কিশোর ও মুসার দিকে তাকাল জোসি। ও আমার লিড ডগ।

মানে নেতা কুকুর? মুসা বলল।

মাথা ঝাঁকাল জোসি। হ্যাঁ।

মনিবের গাল চেটে দিতে লাগল ডায়মণ্ডহার্ট। হেসে মুখ সরিয়ে নিল জোসি।

দলের সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য লিড ডগ, জোসি বলল। হোয়াইট আউটের মধ্যে পড়লে ওকে ছাড়া নিস্তার পাওয়া কঠিন।

হোয়াইট আউট কী? মুসা জানতে চাইল।

তুষার ঝড়, জোসি বলল। যখন তখন শুরু হয়ে যায়। এতই ঘন হয়ে তুষার পড়ে, নিজের হাতও দেখা যায় না। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তবে ডায়মণ্ডহার্টের মত একটা হাস্কি সঙ্গে থাকলে নিরাপদ। পথের মোড়ে কোনখানে কী বিপদ ওত পেতে আছে, নদীর বরফের স্তর কোথায় অতিরিক্ত পাতলা, ভার সইতে না পেরে ভেঙে যাবে, আগে থেকেই সব বুঝতে পারে। ওকে ছাড়া ইডিটারোড রেসে অংশ নেয়ার কথা ভাবতেই পারি না আমি।

রেস শেষ হতে কতদিন লাগে? জানতে চাইল কিশোর।

সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি কুকুরের মাথা চাপড়ে আদর করে দিতে লাগল জোসি। তবে মোটামুটি এগারো-বারোদিনের মত লাগে। ভীষণ বিপজ্জনক আর উত্তেজনায় ভরা এই রেস।

কুকুরগুলোর ওপর নিশ্চয় খুব চাপ পড়ে? মুসার প্রশ্ন।

তা পড়ে। তবে সেটা ওরা পছন্দও করে। শূন্যের বিশ ডিগ্রি নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। শরীর গরম হতে চায় না। মাশিঙের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে ওরা।

মাশিং কী? কুকুরের খাবার?

হাসল জোসি। উঁহু। ডগস্লেজিঙের স্থানীয় নাম মাশিং। ফরাসি শব্দ মার্শা থেকে এসেছে শব্দটা। এর মানে চলো যাই।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, রেসের সময় বাইরের সহযোগিতা পাওয়া যায়?

মাথা নাড়ল জোসি। না। ইডিটারোড রেসে যা যা করার রেসারকে একলাই করতে হয়। নিজের খাবার, কুকুরের খাবার, কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যেতে হয়। টিকে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব সঙ্গে নিতে হয়।

মুসা বলল, তারমানে নিয়ম-নীতি খুব কঠোর।

কঠোর না হয়ে উপায় নেই, জোসি বলল। ইডিটারোড রেসটা শুধু খেলা বা প্রতিযোগিতা নয়, রেসার তৈরিতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেই উনিশশো পঁচিশ সাল থেকে এ নিয়ম চালু আছে। নৌমে সেবার মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল ডিপথেরিয়া। সারা শহরে কোথাও এর ওষুধ ছিল না। গাড়ি আসার রাস্তা ছিল না। প্লেন নামতে পারত না। কিন্তু আলাস্কার কিছু বেপরোয়া ডগস্লেজ মাশার প্রচণ্ড তুষার ঝড়ের তোয়াক্কা না করে অ্যাঙ্কারেজ থেকে নৌমে ওষুধ পৌঁছে দিয়েছিল। বাঁচিয়ে দিয়েছিল শহরটাকে। সেই থেকে ইডিটারোড রেসের গুরুত্ব ভীষণভাবে বেড়ে গেছে এই এলাকার লোকের কাছে। নিউ ইয়র্ক সিটির সেন্ট্রাল পার্কের বিখ্যাত কুকুরের মূর্তিটার কথা নিশ্চয় জানো, বাল্টোর মূর্তি। নৌমের সেই উদ্ধারঅভিযানে একটা দলের লিড ডগ ছিল বাল্টো। ওষুধ আনার পর থেকে হিরো হয়ে গেছে। ডায়মণ্ডহার্টের মাথা চাপড়ে দিতে আবার নিচু হলো ও। আমাদের ডায়মণ্ডও বাল্টোর চেয়ে কম নয়, কি বলিস ডায়মণ্ড? এবারের ইডিটাররাডে আমরাই জিতব। পঞ্চাশ হাজার ডলারের পুরস্কার বাড়িতে আনব।

শিস দিল মুসা। ওর মুখ থেকে বেরোনো বাতাসে তুষারকণার লম্বা একটা রেখা তৈরি হলো। পঞ্চাশ হাজার!

বেশি মনে হচ্ছে? হাসতে লাগল জোসি। তবে এতে যে পরিমাণ বিপদ, সেই তুলনায় টাকাটা খুব বেশি না। পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা। কুকুর ছাড়া একশো গজও যেতে পারবে না।

হাঁটতে হাঁটতে শহরে ফিরে এল ওরা। ওদের বয়েসি আরেকটা ছেলেকে উল্টো দিক থেকে আসতে দেখা গেল। জোসির মত ওর পরনেও চামড়ার পার্কা আর উলের প্যান্ট। মাথার হুড তুলে দেয়া। অন্য দিকে নজর। ওদের যেন দেখেইনি।

ও টেড সিউল, জোসি বলল। গলা চড়িয়ে ডাকল, এই টেড, শোনো। এরা আমার বন্ধু। মেহমান। লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বিচ থেকে এসেছে।

থামল টেড। তবে জোসির দিকে তাকাল না।

টেডও রেসে অংশ নিচ্ছে, জানাল জোসি। ইডিটারোড রেসে এই প্রথমবারের মত প্রতিযোগিতা করতে যাচ্ছি আমরা। গোটা শহর আমাদের নিয়ে উত্তেজিত। অনেকেই বলাবলি করছে প্রতিযোগিতা আমার আর টেডের মধ্যেই হবে। দুজনের যে কোন একজন জিতব।

জ্বলন্ত চোখে জোসির দিকে তাকাল টেড। আমি না জিততে পারলে তোমাকেও জিততে দেয়া হবে না, কথাটা মনে রেখো। তার জন্য যদি আমাকে…

কথাটা শেষ করল না ও। ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল।


দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে জোসিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ও অমন করল কেন?

জানি না, বিষন্ন মনে হলো জোসিকে। সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। কিছুদিন থেকে কী যে হয়েছে ওর, একেবারেই সহ্য করতে পারে না আমাকে। ডগ রেসে বার বার আমার কাছে পরাজয়টা মেনে নিতে পারছে না বোধহয়।

প্রতিযোগিতায় হারজিত তো আছেই, মুসা বলল। তার জন্য এত শত্রুতা? নিশ্চয় তুমি ওর চেয়ে ভাল মাশার, নইলে জেতো কেন?

মাশার! বাহ, চমৎকার উচ্চারণ, হাসি ফুটল জোসির মুখে। শেখো, শেখো, শিখে ফেললা আমাদের ভাষা। কঠিন কিছু না।

মুসার মনে হলো ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল জোসি।

যে রাস্তা ধরে চলেছে ওরা, সেটা গেছে একটা ভোলা চতুরের ধার দিয়ে। পঞ্চান্ন গ্যালনের অনেকগুলো বড় বড় ড্রাম রাখা আছে চত্বরে। পাশে একটা ছোট্ট ছাউনি। ছাউনির ভিতর থেকে আসছে ইঞ্জিনের শব্দ।

কীসের শব্দ জানতে চাইল মুসা।

জেনারেটর, জোসি বলল। ডিজেলে চলে। ওই ড্রামগুলোতে ডিজেল ভর্তি। গরমকালে ইউকনে যখন বরফ থাকে না, তখন বার্জে করে নিয়ে আসা হয়। হিসেব করে বিদ্যুৎ খরচ করতে হয় আমাদের। বসন্তে বরফ গলা শুরু হওয়ার আগে তেল ফুরিয়ে গেলে বিপদ। জেনারেটর চলবে না। বিদ্যুৎ বন্ধ। অন্ধকারে থাকতে হবে রাতের বেলা।

চিন্তিত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছে কিশোর। শহরটা বড় বেশি নিঃসঙ্গ। অস্বস্তি লাগছে ওর। এখানে সব কিছু ঠিকঠাক মত চললে কোন ভয় নেই। কিন্তু যে কোন অঘটন কিংবা অনিয়ম ঘটলে, তা সে যত সামান্যই হোক না কেন, শহরটাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

টেড সিউলের কথা ভাবল কিশোর। রহসময় আচরণ করেছে। জোসিকে জিজ্ঞেস করল, জোসি, টেড যে তোমাকে শাসিয়ে গেল, কতটা ক্ষতি করতে পারে?

আগে আগে হাঁটছে জোসি। ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল, বাদ দাও ওর কথা। কামড়ের চেয়ে ঘেউ ঘেউ বেশি।

হেসে রসিকতা করল মুসা, হাস্কিগুলোর মত।

হাস্কিরা ভীষণ প্রয়োজনীয় প্রাণী, হাসিটা ফিরিয়ে দিল জাসি। টেডের সমস্যাটা হলো, ও শুধুই ফাস্ট হতে চায়। কিন্তু সব তো আর ওর পছন্দমত চলবে না।

কখনও হেরেছ ওর কাছে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

একবার প্রায় হেরে গিয়েছিলাম।

তারমানে হারনি। বুঝলাম, এ জন্যই জেদ বেড়ে গেছে ওর,মুসা বলল। জেদ থেকে শত্রুতা।

প্রতিযোগিতা যত বড় মাপের হয়, উত্তেজনা তত বাড়ে। কিশোর জানে, ইডিটারোড রেসের মত কুকুর-দৌড়ের এতবড় প্রতিযোগিতা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারাটাও বিরাট সম্মানের ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই গ্লিটারবাসীরা এ নিয়ে উত্তেজিত। দুটো দলে ভাগ হয়ে গেছে তারা। কারও সাপোর্ট জোসির পিছনে, কারও টেডের। হেরে গেলে ভক্তদের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না এই দুশ্চিন্তায়ই নিশ্চয় খিটখিটে হয়ে গেছে টেড।

মোড় নিয়ে আরেকটা পায়ে চলা পথে নামল ওরা। লম্বা একজন মানুষকে আসতে দেখল। গায়ে সবুজ পার্কা। পরনে সবুজ টুয়িলের প্যান্ট।

বিগস আসছে, জোসি বলল। ইলকিস বিগস্। কোম্পানির লোক।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, কোন কোম্পানি?

থিম পার্ক কর্পোরেশন, বললাম না তখন। গ্লিটারেও একটা থিম পার্ক বানাতে চায়। প্রতি শীতেই গ্লিটারে এসে হাজির হয় ও। কোম্পানির পক্ষে প্রচার চালায়। এবার একেবারে আটঘাট বেঁধে এসেছে। ভোট না নিয়ে আর যাবে না। হা-না একটা কিছু সিদ্ধান্ত জেনে তবেই যাবে।

মুখে ঝলমলে হাসি নিয়ে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল বিগস্। হ্যালো, জোসি। কিশোর-মুসাকে দেখাল। এরাই নিশ্চয় তোমার রকি বিচের বন্ধু। কিশোর কোন জন, আর মুসা কোন জন?

ও কিশোর, দেখিয়ে দিল জোসি। আর ও মুসা। ইডিটারোড রেসে আমাকে সাহায্য করবে।

কিশোর ও মুসার দিকে তাকিয়ে আন্তরিক হাসি হাসল বিগস্। আলাস্কায় স্বাগতম। তোমরা আসতে না আসতে কীভাবে জেনে গেলাম ভেবে অবাক হচ্ছ নিশ্চয়? এখানে খবর খুব দ্রুত ছড়ায়। আচ্ছা যাই, পরে কথা হবে। জরুরি কাজ আছে আমার।

চলে গেল বিগস্।

লোকটা কিন্তু খুব আন্তরিক, মুসা বলল। কাজের প্রতি ভীষণ সিরিয়াস।

মনে হয়, জোসি বলল।

মনে হয় মানে? তোমার সন্দেহ আছে নাকি?

বাদ দাও, হাত নেড়ে যেন বিগসকে উড়িয়ে দিল জোসি। চলো।

আবার পা বাড়াল ওরা। কিছুদূর এগোতে জোসির কেবিনটা চোখে পড়ল। এটাতেই কিশোরদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিন পাশে বন, একপাশে নদী। নদীর দিকটা ভোলা থাকায় রোদ পাওয়া যাবে।

চাচা-চাচীর কেবিনের দিকে তাকাল জোসি। জানালার পর্দা টানা দেখে বলল, ও, এখনও আসেনি। এত দেরি করছে কেন? তোমরা এখন বিশ্রাম নেবে?

মুসা বলল, ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তবে তোমার জরুরি কাজ থাকলে…

আমার কাজ নেই, জোসি বলল। শ্লেজে চড়ে ঘুরবে?

চেঁচিয়ে উঠল মুসা, নিশ্চয়ই!

চলো, চলো! জবাব দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না কিশোরও।

কুকুরগুলোর কাছে ফিরে এল ওরা। স্টোরেজ শেড অর্থাৎ মালপত্র রাখার ছাউনি থেকে ওক কাঠে তৈরি স্লেজটা বের করতে জোসিকে

সাহায্য করল দুজনে।

স্লেজের আকার দেখে মুসা অবাক। এত লম্বা?

প্রচুর খাবার আর জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে হয়, জোসি বলল। চলার পথে ঘুমানোর কাজটাও গাড়িতেই সারতে হয়। বড় করে তো বানাতেই হবে।

গাড়ির সঙ্গে লম্বা এক সারি লাগাম জুড়ে দিতে লাগল জোসি। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝে ফেলল কুকুরগুলো। আগ্রহ আর উত্তেজনায় প্রচণ্ড চিৎকার আর লাফালাফি শুরু করল।

গাড়িতে জোতা শিখবে? জিজ্ঞেস করল জোসি।

এতে শেখার কি আছে? মুসা বলল, লাগাম পরিয়ে দিলেই হয়।

না, হয় না। উল্টোপাল্টা লাগালে হবে না। এরও নিয়ম আছে। গাড়ির কাছ থেকে সারি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গাড়ির একেবারে কাছে যে কুকুরগুলোকে বাঁধা হবে, ওগুলোকে বলে হুইল ডগ। আগের কুকুর পিছে, আর পিছের কুকুর আগে বাঁধলে ঠিকমত টানতেই পারবে না।

একটা কুকুরের বাঁধন খুলে স্লেজের একেবারে কাছের সুটটার সামনে নিয়ে এল জোসি। প্যাড লাগানো লাগামটা পরিয়ে দিতে লাগল। বাধা দিল না কুকুরটা।

ওদের মনিব কে, সেটা ওদেরকে ভালমত বুঝিয়ে দিতে হবে, জোসি বলল। দুর্বলতা প্রকাশ করা চলবে না কোনভাবেই। বাঁধন খুলে কীভাবে কুকুরকে নিয়ে আসতে হয়, দেখলে। এখন যাও। মুসা, তুমি রেড লাইটকে নিয়ে এসো। আর কিশোর, তুমি হোয়াইট ক্লাউডকে।

কোনটা রেড লাইট আর কোনটা হোয়াইট ক্লাউড, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল জোসি। বাঁধন খুলে কলার ধরে কুকুর দুটোকে স্লেজের কাছে টেনে নিয়ে এল কিশোর ও মুসা। সেগুলোকে লাগামের সঙ্গে জুড়ে দিতে লাগল জোসি। ডায়মওহার্টের পালা এল সবশেষে। চোখের আন্দাজে মেপে দেখল কিশোর। টানার সময় গাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে থাকবে এই নেতা-কুকুরটা। কুকুরের এই স্লেজ চালানোর জন্য অনেক জায়গা লাগে।

প্রচণ্ড শক্তি ও আত্মবিশ্বাসে ভরা একটা পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়েছে যেন হাস্কি কুকুরের সম্মিলিত দলটা। ক্রমাগত লেজ নেড়ে নেড়ে লাফানো শুরু করেছে কুকুরগুলো। ছোটার জন্য অস্থির। যেন শুধু এ কাজটা করার জন্যই বেঁচে আছে ওরা। গাড়ি টেনে নিয়ে দৌড়ানোটা যেন ওদের নেশা।

ভালমত দৌড় করিয়ে আনতে হবে ওদের, জোসি বলল। গাড়িতে ওজন দরকার। মালপত্র তো নেই, সে-জায়গাটা তোমরা পূরণ করো। গাড়িতে গিয়ে বসো।

উঠে বসল মুসা। মুখোমুখি বসল কিশোর। শ্লেজের পিছনে রানারের ওপর উঠে দাঁড়াল জোসি।

দারুণ গাড়ি। স্টিয়ারিং হুইল নেই। অ্যাক্সিলারেটর নেই, মুসা বলল।

সিটবেল্ট নেই। এয়ারব্যাগ নেই, বলল কিশোর।

হাসাহাসি করতে লাগল তিনজনে।

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল ডায়মণ্ডহার্ট। উত্তেজনায় কাঁপছে। কিশোরের মনে হলো, কুকুরটাও যেন মজা পাচ্ছে ওদের রসিকতায়।

কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল জোসি, হাইক! হাইক!

জমাট তুষারে পা বসিয়ে টান দিল কুকুরগুলো। একসঙ্গে ঝাঁপ দিল সামনের দিকে। অসমতল বরফের ওপর দিয়ে ঝাকি খেতে খেতে নদীর দিকে ছুটল স্লেজ। আচমকা এই তীব্র গতিবেগ অবাক করল কিশোর ও মুসাকে।

হাইক! হাইক! আবার চিৎকার করে উঠল জোসি। বাঁ পায়ের ভর রানারে রেখে ডান পা নামিয়ে লগি দিয়ে নৌকা বাওয়ার মত করে ঠেলা মারছে, গতি বাড়াতে সাহায্য করছে কুকুরগুলোকে।

পার্কার গলার কাছের ফিতে বাধল কিশোর। মাথার হুড তুলে কান ঢাকল। বাতাসে বরফের ছোঁয়া। হাঁটার সময় এত গতিও থাকে না, এত বাতাসও লাগে না। কনকনে ঠাণ্ডা ইতিমধ্যেই ওর নাক-গাল অসাড় করে দিয়েছে।

নদীর পাড়ে পৌঁছল গাড়ি। জমাট বরফের ওপর গাড়িটা লাফিয়ে ওঠার সময় থাবা দিয়ে গাড়ির ধার খামচে ধরল কিশোর। ওর মনে হলো, আকাশে উড়াল দিয়েছে স্লেজ।

মহা আনন্দে চিৎকার করে উঠল মুসা, ইয়াহু!

পিচ্ছিল বরফে উঠে আসায় গতি বেড়ে গেল স্লেজের। আরও জোরে টানতে লাগল কুকুরগুলো। গতি বাড়ানোর জন্য ওগুলোরও যেন রোখ চেপে গেছে।

চিৎকার করে বলল জোসি, আরে থাম, থাম!

শীতের রৌদ্রালোকে ঝকঝক করছে সাদা বরফ। চোখে লাগে। চোখের পাতা সরু করে চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর। দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সীমাহীন আলাস্কার বরফে ঢাকা এই আদিম প্রকৃতিতে কিছুই নড়ছে না, কোন শব্দ নেই, একমাত্র বরফের ওপর দিয়ে ছুটে চলা স্লেজ ও একপাল কুকুরের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।

সামনে দুই ভাগ হয়ে গেছে পথটা। চিৎকার করে ডায়মণ্ডহার্টকে নির্দেশ দিল জোসি, জি! ডায়মণ্ড, জি!

মুহূর্তে ডানে মোড় নিল ডায়মণ্ডহার্ট।

ডানে ঘোরার জন্য জি, কিশোর বলল, বাঁয়ে ঘোরাতে হলে?

হউ! জোসি বলল। স্লেজ ডগকে প্রথম যে দুটো শব্দ শিখতে হয়, তা হলো এই জি আর হউ।

ভীষণ ঠাণ্ডা! মুসা বলল।

হ্যাঁ।

তাপমাত্রা এখন শূন্যের বিশ ডিগ্রি নীচে।

নদীর ওপর দিয়ে কোণাকুণি ছুটছে স্লেজ। বহু ব্যবহৃত পথটা দেখে বোঝা যায় মাত্র একটা স্লেজ চালিয়ে এই রাস্তা তৈরি করা সম্ভব নয়। শহরের অন্য মাশাররাও নিশ্চয় এই পথ ব্যবহার করে। লাকড়ি আনতে নদী পেরিয়ে বনে যায়। ইউকন নদীটা শীতকালে হয়ে যায় গ্লিটারবাসীর মহাসড়ক।

কে আসে দেখো! জোসি বলল।

একসঙ্গে ফিরে তাকাল কিশোর-মুসা দুজনেই।

ওদিকে নয়, বাঁয়ে তাকাও, জোসি বলল।

গলা লম্বা করে বাঁয়ে তাকাল কিশোর। নদীর তীর ধরে আরেকটা কুকুর-বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখল। জোসিকে জিজ্ঞেস করল, কে, টেড নাকি? তোমার সঙ্গে রেস খেলতে আসছে?

নাহ্, প্র্যাকটিস করছে।

দৌড়াচ্ছে তো খুব জোরে, বিড়বিড় করল মুসা। পালাচ্ছে নাকি?

পালাবে কেন? টেডের দিকে তাকিয়ে আছে জোসি। গাড়িতে মালপত্র নেই, বোঝা নেই, সে-কারণেই গতি বেশি। এভাবে প্র্যাকটিস করাটা ভুল। তাতে আসল রেসের সময় যখন বোঝা নিয়ে দৌড়াবে কুকুরগুলো, অনভ্যস্ততার কারণে অসুবিধে হবে ওদের। যা ইচ্ছে করুকগে, আমার কী।

টেডকে ভাল করে দেখার জন্য অনেকখানি ঘাড় ঘোরাল কিশোর।

আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, জোসি, এত ধােয়া কেন শহরে?

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল জোসি। চমকে গেল সে-ও। হুয়া! হুয়া! বলে উত্তেজিত চিৎকার করে থামতে বলল কুকুরগুলোকে। এত জোরে ব্লেড-ব্রেক চেপে ধরল, তুষারে বসে গেল ব্রেকের ব্লেড। নৌকার মত দুলে উঠল স্লেজ। প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগল।

দাঁড়িয়ে গেল ডায়মণ্ডহার্ট সহ বাকি কুকুরগুলো।

কিছু একটা হয়েছে, চিন্তিত ভঙ্গিতে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে জোসি। শহরের একধারে কালো ধোয়ার মোটা একটা রেখা আকাশে উঠে যাচ্ছে।

কীসের ধোঁয়া? জানতে চাইল মুসা।

চাচার কেবিনে আগুন লেগেছে! জোসি বলল।


স্লেজ থেকে নেমে পড়ল জোসি। চেঁচিয়ে বলল, নামমা! নামো! গাড়ি ঘোরাতে হবে!

লাফিয়ে নামল কিশোর-মুসা। দৌড় দিল জোসির পিছনে। রুক্ষ বরফ। লাগাম পরা অবস্থায়ই কুকুরগুলোকে টেনে নিয়ে এল ওরা। গ্লিটারের দিকে মুখ করাল। স্নেজের মুখও ঘুরিয়ে দিল একই দিকে।

লাফ দিয়ে আবার স্নেজে গিয়ে উঠল কিশোর-মুসা। লাগাম ধরে চিৎকার করে উঠল জোসি, ডায়মণ্ডহার্ট! হাইক! হাইক!

সামনে ঝাঁপ দিল কুকুরটা। বরফে নখ বসাল। ওর পেশীবহুল শক্তিশালী বুকে চেপে বসল চামড়ার লাগাম। দেখাদেখি বাকি কুকুরগুলোও একই কাজ করল। ছুটতে শুরু করল স্লেজ।

নদীর ভাটির দিকে চলেছে এখন ওরা। জেফরি টিনুকের কেবিনের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে কালো ধোঁয়া।

ফুল স্পিডে কুকুরগুলোকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল জোসি। চিৎকার করে ক্রমাগত নির্দেশ দিতে থাকল, টান, ডায়মণ্ড, টান! টেনে যা!

লাগামের সঙ্গে গা মিলিয়ে দেহটাকে টান টান করে ফেলেছে ডায়মণ্ডহার্ট। জরুরি অবস্থা আঁচ করে ফেলেছে কুকুরগুলো।

জোসি, কী হয়েছে বলো তো? এতক্ষণে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল কিশোর।

বুঝতে পারছি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে জবাব দিল জোসি। অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তবে আগুন লাগাটা এখানে ভয়ানক ব্যাপার। পুরো শহরটাই কাঠের তৈরি।

টেডের দিকে তাকাল কিশোর। শহর থেকে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে ওর স্লেজ। অবাক হলো কিশোর। আগুন দেখেনি নাকি? ওকে বলা দরকার।

চিল্কার করে ডাকল জোসি, টেড! এই টেড!

ফিরেও তাকাল না টেড। যেন জোসির ডাক ওর কানেই ঢোকেনি।

আবার ডাকল জোসি। এবারও তাকাল না টেড। কুকুর-বাহিনী নিয়ে ছুটতে ছুটতে সরে যেতে লাগল শহর থেকে দূরে।

থামল না কেন? মুসার প্রশ্ন।

এতদূর থেকে বোধহয় আমার ডাক শুনতে পায়নি, জবাব দিল জোসি।

কিন্তু কিশোরের যথেষ্ট সন্দেহ হলো। সমতল জমাট বরফের ওপর দিয়ে এমনিতেই শব্দ চলে বহুদূর। তা ছাড়া এখানে বাধা দেবার মতও কিছু নেই। জোসিকে উপেক্ষা করার জন্য শুনেও না শোনার ভান করেছে টেড। জরুরি কাজে সহায়তা করার জন্য ওকে ডাকা হয়েছে, সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারেনি।

ওদেরকে নদীতীর পার করিয়ে আনল ডায়মণ্ডহার্টের দল। কেবিনের কাছের সমতল জায়গাটায় পৌঁছল স্লেজ। গাড়ি থামাল জোসি। লাফিয়ে নামল কিশোর ও মুসা।

ইতিমধ্যে শহরের লোক জড় হয়ে একটা স্বেচ্ছাসেবী অগ্নিনির্বাপক-বাহিনী গঠন করে ফেলেছে। নারী-পুরুষ সবই আছে তাদের মধ্যে। সবার হাতে বালতি। কেবিনের কাছ থেকে লম্বা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে ওরা। সারির এক মাথা একটা পানির ট্যাংকের কাছে, অন্য মাথা কেবিনের কাছে। হ্যাণ্ড পাম্প লাগানো একটা লম্বা হোস পাইপ নিয়ে দৌড়ে এল তিনজন লোক।

দমকল নেই? চারপাশে তাকিয়ে দমকলের গাড়ি খুঁজতে লাগল মুসার চোখ।

নাহ, জোসি জানাল।

ট্যাংক থেকে পানি নিয়ে বালতি এগিয়ে দিতে থাকল অগ্নিনির্বাপকদের বালতি-বাহিনী। কেবিনের সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়েছে চওড়া কাঁধওয়ালা একজন শক্তিশালী পুরুষ। পাশের লোকটার হাত থেকে বালতি নিয়ে পানি ছুঁড়ে দিচ্ছে আগুনের ওপর। খালি বালতিটা পাশের লোকটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আরেকটা ভরা বালতি নিচ্ছে ওর হাত থেকে। হাতে হাতে খালি বালতিটা চলে যাচ্ছে ট্যাংকের কাছে, পানি ভর্তি হয়ে আবার ফিরে আসছে প্রথমজনের হাতে। পানি বহনের কাজ দ্রুত চলছে এভাবে।

তুষার সরানোর একটা বেলচা তুলে নিয়ে কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিল জোসি। আরেকটা দিল মুসাকে। তৃতীয় আরেকটা নিজে নিয়ে চিৎকার করে বলল, আগুনে তুষার ফেলতে থাকো। বেলচা তুলে দেখাল, ওই যে আমার চাচা-চাচী।

বেলচায় করে তুষার তুলে নিয়ে কেবিনের খোলা জানালা দিয়ে ভিতরে ছুঁড়ে দিল কিশোর। ফেলতে থাকল এভাবে। কঠিন কাজ। অল্পক্ষণেই হাঁপিয়ে গেল। মুখ দিয়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বরফ-কণায় রূপান্তরিত হচ্ছে বাতাস। বিচিত্র আকৃতি। কোনটা রিঙ, কোনটা লম্বা। মুসাও পাল্লা দিয়ে তুষার ফেলছে ঘরের ভিতর। ঘোঁৎ-ঘোৎ শব্দ বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। এখন ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে আরও অনেকে। জ্বলন্ত কেবিনটা ঘিরে ফেলেছে অগ্নিনির্বাপক-বাহিনী।

তুষার ফেলার দিকেই কিশোরের নজর ছিল এতক্ষণ, এখন খেয়াল করে দেখল, আগুনের শিখা আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভলকে ভলকে উঠে যাওয়া সাদা ধোঁয়া। আগুনের কারণে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হয়েছিল এতক্ষণ মেরুর ঠাণ্ডা। সুযোগ পাওয়ামাত্র কামড় বসাল আবার। গায়ে। কিশোরের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল।

আগুনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা মানুষগুলো উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। চওড়া হাসি ফুটল কিশোর-মুসা-জোসির মুখেও। একে অন্যের পিঠ চাপড়ে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল ওরা।

চাচা-চাচী আর চাচাত বোন মুনস্টোনের সঙ্গে কিশোর ও মুসাকে পরিচয় করাতে টেনে নিয়ে গেল জোসি। স্তব্ধ হয়ে গেছে টিনুক পরিবার। সহায়-সম্পত্তি বলতে যা ছিল ওদের, কেবিনটার সঙ্গে সঙ্গে সব গ্রাস করে নিয়েছে আগুন।

খুব খারাপ লাগছে আমার, মিস্টার টিনুক, সহানুভূতির সুরে কিশোর বলল।

জোর করে মুখে দুর্বল হাসি ফোটালেন জোসির চাচী। জবাবটা তিনিই দিলেন। থ্যাংক ইউ। মিস্টার বলা লাগবে না, ওকে শুধু জেফরি বললেই চলবে। আমাকে এরিনা। আমরা এখানে অত সৌজন্য আর ফর্মালিটির ধার ধারি না। তোমাদের জন্য আমারও খারাপ লাগছে। গ্লিটারে এলে বেড়াতে, আর এ সময়ই এ রকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। খাতির-যত্নও করতে পারব না ভালমত। আজ রাতটা কোথায় কাটাব, সেটাই জানি না।

অত চিন্তা করছ কেন, চাচী, জোসি বলল। আমাদের বড় কেবিনটাতেই থাকো। ধীরে সুস্থে তোমাদের কেবিনটা আবার বানিয়ে নিয়ো।

নিজেদের কেবিনের পোড়া দরজার কাছে গিয়ে ভিতরে উকি দিলেন জোসির চাচা। দেখে, ফিরে এলেন আগের জায়গায়।

মুন জিজ্ঞেস করল, কী দেখলে, বাবা?

মুনকে দেখছে মুসা। বয়েসে ওদের চেয়ে বছরখানেকের ঘোট। সুন্দরী। গভীর নীল চোখ।

পিছন দিকটাতেই ক্ষতি বেশি হয়েছে, জেফরি জানালেন। কিছু জামা-কাপড় আর ফার্নিচার বোধহয় বাঁচানো যাবে।

বাঁচানো গেলেও সাফ করতে জান বেরোবে, মুন বলল। যে পরিমাণ কালিঝুলি আর ছাই পড়েছে।

স্টোভটা জ্বেলে দিয়ে আসি, জোসি বলল।

মুসা জিজ্ঞেস করল, আমরা কোনও কাজে লাগতে পারি?

মাথা নাড়ল জোসি, না। আমিই পারব।

যে কেবিনে কিশোরদের থাকতে দিয়েছে, তার পরের কেবিনটার দিকে এগোল জোসি।

জেফরির দিকে ফিরল কিশোর। আগুন লাগল কীভাবে?

জানি না, মাথা নাড়লেন জেফরি। লাকড়ি আনতে বনে গিয়েছিলাম আমরা। ফিরে এসে দেখি জানালায় আগুনের আলো। দেখেই বুঝে গেলাম, চিমনির আগুন না।

কী করে বুঝলেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।

জবাব দিতে যাচ্ছিলেন জেফরি, বাধা দিল মুন। ফিসফিস করে বলল, বাবা, আস্তে। ব্ৰিণ্ডল জ্যাক আসছে।

শক্ত হয়ে গেল জেফরির চোয়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আসতে দাও!

ঘুরে তাকাল কিশোর। ব্ৰিণ্ডল জ্যাককে দেখল। চেহারা আর ভাবভঙ্গি সন্দেহ জাগায়। মুখে বিচিত্র বাঁকা হাসি। ঠোটের এক কোণ বাঁকিয়ে হাসে। চোখে কুটিল দৃষ্টি।

দুঃখই লাগছে, জেফ, জ্যাক বলল। অবশ্য এমনিতেও পুরানো হয়ে গিয়েছিল কেবিনটা, নতুন আরেকটা বানাতে হতই। দেরি না করে শুরু করে দাও, বানাতে সময় লাগবে না। যে কাজটা ভাল, পারো, সেটা বাদ দিয়ে কেন যে জানোয়ার ধরতে যাও বুঝি না। ওসব তোমার কর্ম নয়। একটা পরামর্শ দিই শোনো, এখনও সময় আছে, জানোয়ার ধরা বাদ দিয়ে কেবিনের ব্যবসায় লাগো। গ্লিটারকে যদি সত্যিই থিম পার্ক বানানো হয় কখনও-এবং আমার বিশ্বাস, হবে-তাহলে কাজের অভাব হবে না তোমার।

তোমার পরামর্শ ছাড়াই এতকাল কাটিয়েছি, বাকি দিনগুলোও কাটাতে পারব! কঠিন কণ্ঠে বললেন জেফরি।

জ্যাকের ঠোটের কোণে হাসিটা বাড়ল। এই একটিবার অন্তত আমার পরামর্শ তোমাকে শুনতেই হবে, জেফ, নইলে শীতে জমে মরবে। যদি চাও তো তোমার কেবিন বানানোয় সাহায্য করতে পারি আমি।

ব্যঙ্গ করছে কি না জ্যাক বোঝা গেল না।

ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। চোখের পাতা সরু হয়ে এল। এত হাসি কেন তোমার মুখে, ব্ৰিণ্ডল? আগুন লাগানোয় তোমার হাত ছিল না তো?

না, ছিল না, সহজ কণ্ঠে জবাব দিল জ্যাক। থাকলে নিভানোয় সাহায্য করতে আসতাম না। তুমি তোক ভাল না, জেফ, তাই অন্যের জায়গায় ফাঁদ পেতে শয়তানি করতে পারো, কিন্তু আমি তো আর তোমার মত নই। যাক, কেবিনটা পুড়ে যাওয়ায় কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারব। এখানে তোমাকে কেবিন বানানোয় ব্যস্ত থাকতে হবে, বনে গিয়ে আমার ফাঁদ পাতায় বাগড়া দিতে পারবে না। টেনে টেনে হাসতে লাগল ও।

মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল জেফরির হাত। শঙ্কিত হলো কিশোর। হাতাহাতি না বেধে যায়।

মুসাও চোখের পাতা সরু করে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে আছে।

আগুনটা কীভাবে লেগেছে বলে তোমার ধারণা? জেফরি জিজ্ঞেস করলেন।

এটা কোনও প্রশ্ন হলো? জ্যাক বলল, ম্যাচের কাঠি, মশালের আগুন, ঘরের মধ্যে হ্যারিকেন উল্টে পড়া… কাঠের কেবিনে আগুন ধরানোটা কোন ব্যাপারই না। যেভাবেই ধরুক, তোমার কেবিনটার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে, জেফ। কিন্তু কী আর করবে। অ্যাক্সিডেন্ট তো আর বলে কয়ে আসে না।

ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল জ্যাক। ওর পিছু নিতে যাচ্ছিলেন জেফরি। ধরে ফেললেন এরিনা। না না, যেয়ো না।… বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে। ঘরে চলো। চা খাই। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।

বাবা-মা চলে গেলে কিশোরদের দিকে ফিরল মুন। ফাঁদ পাতা নিয়ে বাবা আর ব্ৰিণ্ডল আঙ্কেলের ঝগড়াটা চিরকালের। দেখা হলেই শুরু করে। ঝগড়া না করে ওই সময়টা যদি থিম পার্ক নিয়ে মাথা ঘামাত, ভাল করত। থিম পার্কের কথা জোসি তোমাদের কিছু বলেছে নাকি?

বলেছে, জবাব দিল মুসা। পার্ক বানানোর ব্যাপারে তোমার বাবার কী মত?

বাবা পুরোপুরি এর বিপক্ষে, মুন বলল। বাবা বলে, থিম পার্কটা হতে দিলে আমরা হয়ে যাব সার্কাসের জানোয়ার। টুরিস্টরা আসবে, এমন ভঙ্গিতে তাকাবে আমাদের দিকে, যেন আমরা অদ্ভুত কোন জীব। প্রকৃতির মাঝে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারও হারাব আমরা।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, ব্রিণ্ডল জ্যাক কী বলে? সে কোন্ পক্ষে?

কীভাবে বলি? ও একটা অদ্ভুত চরিত্র। বাবা যদি কিছু করে, সে করবে ঠিক তার উল্টো। জেদ করেই যেন করে এ সব। হয়তো এ ক্ষেত্রেও বিপক্ষেই যাবে।

সেজন্যই কি তোমাদের কেবিনে আগুন ধরাল? হেসে বলল মুসা।

মুসার দিকে তাকাল মুন। না, এত পাগল না! শহরের বাড়িঘর যে সব কাঠের তৈরি, তা তো নিশ্চয় দেখেছ। শীতকালে শুকিয়ে ঠনঠনে হয়ে থাকে। বাতাস বইছে না বলে আজ বেঁচে গেছি। একটু বাতাস থাকলেই আমাদের কেবিনের আগুন সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ত। পুড়ে ছাই হতো গোটা শহর। পাগল হয়ে না গেলে এখানকার কোন লোক কারও ঘরে আগুন দেবে না, সেটা যার ঘরই হোক।

দুজনকে নিয়ে জোসিদের কেবিনে ঢুকল মুন। ঘরের ভিতরটা এখনও ঠাণ্ডা। তবে স্টোভের আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। ঘর গরম হতে দেরি হবে না। গায়ের পার্কা খুলে ফেললেন এরিনা। ঝুলিয়ে রাখলেন দরজায় গাঁথা হুকে। পাঁচ গ্যালনের একটা ক্যান থেকে কেটলিতে পানি ঢেলে চুলায় চাপালেন।

দুটো খালি ক্যান তুলে নিতে নিতে মুন বলল, আরও পানি লাগবে। ঝর্না থেকে নিয়ে আসিগে।

একটা ক্যান দাও আমার হাতে, হাত বাড়াল মুসা। আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

হাসল মুন। দরকার নেই। তুমি ভাবছ আমার কষ্ট হবে? এ সব আমাদের দৈনন্দিন কাজ, জন্মের পর থেকে করে আসছি। শ্লেজ নিয়ে চলে যাব। কোনও অসুবিধে হবে না।

মুন বেরিয়ে গেলে জোসি ঢুকল। মলিন হাসি হেসে বলল, খুব বিরক্ত লাগছে, না? আমাদের জীবন এমনই। বিপদে ভরা। নানা

প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের টিকে থাকতে হয়।

জোসি, এরিনা বললেন, তুমি চলে যাওয়ার পর ব্ৰিণ্ডল এসেছিল। আরেকটু হলেই হাতাহাতি বেধে যাচ্ছিল দুজনে।

কী নিয়ে? থিম পার্ক?

ঝগড়া তো করল ফাঁদ পাতা নিয়ে, তবে আমার মনে হয় থিম পার্কের পরিকল্পনাটাই আসল কারণ। তোমার চাচা যেহেতু পার্ক বানানোর বিপক্ষে, জানা কথা ব্ৰিণ্ডল যাবে পক্ষে, সব সময় উল্টো, এটাই তো হয়ে আসছে। ভোটটা শেষ হলে বাঁচি। এদিক ওদিক কিছু একটা হয়ে যাক। শহরটাকে দুই ভাগ করে ফেলেছে ওই থিম কোম্পানি। সবার ওপর সবাই খেপা। এমন তো কখনও হয়নি। এ কী গজব নেমে এলো!

কোন দল জিতছে? জানতে চাইল কিশোর।

মুখ বাঁকাল জোসি। বোঝা যাচ্ছে না। আগামী হপ্তায় ভোটাভুটি শেষ হওয়ার আগে বুঝতে পারবও না কিছু। কেউ মুখ খোলে না। কে যে কাকে সাপোর্ট করছে, বোঝা কঠিন।

লুক স্টার্লিঙের কথাই ধরা যাক। সে কাকে সাপোর্ট দিচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে দেয় না, এরিনা বললেন। চালাক তোক তো। ওর দোকান থেকে মাল কেনা বন্ধ করে দেবে এই ভয়ে কাস্টোমারদের বুঝতে দেয় না কোন পক্ষ সমর্থন করে ও। সবার মন রক্ষা করে চলতে চায়।

অকারণ ভয়, জেফরি বললেন। লোকে ওর দোকান থেকে জিনিস কিনতে বাধ্য, কেউ ওকে পছন্দ করুক বা না করুক।

টেডের ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞেস করল মুসা।

হাসল জোসি। টেডের এখন একটাই ভাবনা, ইডিটারোড রেসে আমাকে পরাজিত করা। এ ছাড়া ওর মগজে আর কোন চিন্তা খেলে না। ওর বাবা মিস্টার সিউল থিম পার্কের পক্ষে। শুনলাম, ব্ৰিণ্ডলও গিয়ে তার সঙ্গে খাতির জমিয়েছে।

সিউলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমি, জেফরি বললেন। চুপ করে থাকে, কোন জবাব দেয় না। মুশকিল। ওদের ধারণা, পার্ক হলে শহরের ক্ষতি না হয়ে বরং লাভ হবে, আয় বেড়ে যাবে লোকের।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কিশোর। মাত্র কয়েক গজ দূরে মাথা তুলে রেখেছে কালোবন। জেফরি, জোসি, জোসির বাবা-সবার কেবিনই এই বনের মধ্যে। কেউ আগুন লাগাতে চাইলে বনের ভিতর দিয়ে এসে সহজেই কাজটা সেরে যেতে পারে। জেফরিকে কথাটা বলতে যাচ্ছিল কিশোর, কিন্তু তার আগেই জানালায় এসে পড়ল একটা ভারী জিনিস। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাঁচ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ